মেহেরপুর প্রতিনিধি।।স্বাধীনতার সূতিকাগার মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালি গ্রামের কানাই শেখের চার সন্তানের মধ্যে ওয়ালিউল হোসেন বারী দ্বিতীয়। মেহেরপুর জেলার একমাত্র ব্যক্তি ওয়ালিউল হোসেন বারী যিনি মরনোত্তর বীর প্রতীক পদকে ভুষিত হয়েছেন। বীরপ্রতীক শহীদ ওয়ালিউল হোসেনের নাম মেহেরপুর জেলার অনেকেই এখনো জানেনা।
১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাইশ বছর বয়সেই তিনি যোগ দেন মুজাহিদ বাহিনীতে আর ৩২ বছর বছর বয়সে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ৮ নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি। এ সেক্টরের অধীনে মেহেরপুরের তৎকালীন এসডিও তৌফক-ই-এলাহী চৌধুরী ও কোম্পানি কমান্ডার লে. খন্দকার নুরুন্নবীর নেতৃত্বে বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা ও ফরিদপুর জেলায় অংশ বিশেষ বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই বীর যোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ১২ নভেম্বর গভীর রাতে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ব্যাংগাড়ি মাঠে পাকস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধের এক পর্যায়ে চোঁখে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ওয়ালিউল। প্রচন্ড গোলাগুলির কারণে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তাঁকে সরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন সহযোদ্ধারা। তার কথা না ভেবে শত্রুদের মোকাবেলা করতে সহযোদ্ধাদের অনুরোধ করেন ওয়ালিউল হোসেন। যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর কয়েকজন নিহত হলে তারা পিছু হটে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি ওয়ালিউলকে। যুদ্ধ শেষে সেখানেই ওয়ালিউল হোসেনের লাশটি দাফন করা হয়। কথাগুলো জানান শহীদ ওয়ালিউল হোসেনের সহযোদ্ধা মহির উদ্দিন শেখ ও জসিম উদ্দীন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের জীবন সংগ্রাম নিয়ে কালবেলা প্রতিবেদকের সাথে স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে বীরপ্রতীক ওয়ালিউল হোসেনের স্ত্রী জাবেদা খাতুন (৭৫) স্মরণ করেন একাত্তরের অনিশ্চয়তা ও বিভিন্ন প্রতিকূলতা নিয়ে। তিনি বলেন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যান ওয়ালিউল হোসেন। বাড়িতে তার মা আত্তাফোন ও স্ত্রীকে পরামর্শ দেন ওয়ালিউলের তিন কন্যাকে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের শিকারপুর রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়ার। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শিকারপুর আশ্রয় ক্যাম্পে থাকাকালীন সময়ে ওয়ালিউল হোসেন বারী কয়েকবার তাদের সাথে দেখা করে আসেন। তিনি আরও বলেন ওপাড় থেকে আমরা যুদ্ধের গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেতাম আর ভয়ে থাকতাম, কান্না করতাম আর হয়তো প্রিয় মানুষটি ফিরে আসবে না। একদিন সত্যই যুদ্ধে শহীদ হয়ে যান তিনি।দেশ স্বাধীন হবার পর বাড়ি ফেরার সময় ব্যাংগাড়ির মাঠে বীরপ্রতীক শহীদ মুজাহিদ ওয়ালিউল হোসেনের কবর পরিবারের স্বজনদের নিয়ে একবারের মতো দেখতে ছুটে যান।
একাত্তর পরবর্তী সময়ে বীরপ্রতীক ওয়ালিউল হোসেনের স্ত্রী সন্তানদের মাথা গোজার কোন ঠাই ছিলো না, একাত্তর পরবর্তীতে আনসার বাহিনীর পক্ষ থেকে কুষ্টিয়াতে একটি যায়গায় তাকে থাকার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি ফিরে আসেন মুজিবনগরের মোনাখালি গ্রামে। অভাবের সংসারে অনাহারে অর্ধাহারে তিনি সন্তানদের লালন পালন করেছেন।উচ্চ শিক্ষা দিতে পারেন নি। কান্নাবিজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন জাবেদা খাতুন।
শহীদ হওয়ার সময় স্ত্রী জবেদা খাতুন ও তিন মেয়েকে রেখে যান ওয়ালিউল। অভাবের সংসারে হাল ধরেন তার স্ত্রী। বড় মেয়ের তখন বয়স ছিল ৬ থেকে ৭ বছর। ১৯৮০ সালে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান মেঝ মেয়ে রেবেকা। অনেক কষ্টে মেয়েদের বড় করেন। এখন দুই মেয়ে-জামাই ও নাতি-নাতনি নিয়ে দিন কাটছে তার। কিছুদিন আগে তার ছোট জামায় মারা পেছেন।অভাব-অনটনের সংসারে ওয়ালিউল হোসেনের শূন্যতা নিয়েই দিন পার করছে পরিবারের সদস্যরা।
২০০৪ সালের আনসার বাহিনীর পক্ষ থেকে বীরপ্রতীক শহীদ ওয়ালিউল হোসেনের পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি ঘর নির্মান করে দেওয়া হয়। শফিপুর আনসার একাডেমিতেও ৩ নং গেট বীরপ্রতীক ওয়ালিউল এর নামে উৎসর্গ করা হয়। এখন তারা বিভিন্ন সরকারী সুযোগ সুবিধা পান। তিনি জানান, স্বামী দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। এতেই গর্ব তাদের। পেয়েছেন সরকারী অনেক সহযোগীতা। তবে স্বামীর কবরটি পড়ে আছে সেই ব্যাংগাড়ির মাঠে। আজও সংরক্ষণ করাও হয়নি এটাই তাদের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ।
ওয়ালিউল হোসেনের বড় মেয়ে কাজল রেখা বলেন, আমার বয়স যখন ৬ থেকে ৭ বছর তখন বাবাকে হারিয়েছি। তখন আমার বুদ্ধিও হয় নি। বাবাকে ছাড়ায় অনেক কষ্টের মধ্যেই মায়ের কাছে বড় হয়েছি। বাবার কথা মনে পড়লে অনেক কষ্ট হয়।
ছোট মেয়ে হাদেছা খাতুন বলেন যখন বাবা শহিদ হন তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ৩ মাস। তিনি বলেন, বাবার স্মৃতি শুধু ছবিতেই দেখেছি। ওয়ালিউল হোসেনের নাতনি মৌসুমি আক্তার ও স্কুল শিক্ষক রাজু বলেন, আমরা বড় হয়ে জানতে পারি আমার নানা দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। এতেই আমাদের গর্বে বুক ভরে যায়।
(Visited 8 times, 1 visits today)
Total Page Visits: 205 - Today Page Visits: 1